শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রেখে শিক্ষার্থীরা কি ঝুঁকি মুক্ত? নাকি এরচেয়ে বড় ঝুঁকি অপেক্ষা করছে। সময়ের বাতিঘর অনলাইন।
কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে শিক্ষা ও শিক্ষার্থীরা চরম অনিশ্চয়তায় পড়েছে। প্রায় সাত মাস ধরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। কবে খুলবে, তার হদিস নেই। কারণ, সংক্রমণ এখনো নিয়ন্ত্রণের বাইরে। লক্ষণও তেমন আশাব্যঞ্জক নয়।
এই পরিস্থিতি নজিরবিহীন। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের পর এত দীর্ঘ সময় ধরে আর কখনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকেনি। কোনো পাবলিক পরীক্ষাও বাতিল হয়নি। সংগত কারণে সরকার আপাতত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার পথেই হাঁটছে। শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্যঝুঁকির কথা বিবেচনা করে কয়েক দফায় ছুটি বাড়ানো হয়েছে। গত ১৭ মার্চ থেকে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। সর্বশেষ ঘোষণা অনুযায়ী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছুটি ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত। যদিও শিক্ষা মন্ত্রনালয়ের জৈষ্ঠ্য আধিকারিকরা বলছেন যে, তাঁরা একাধিক বিকল্প নিয়ে এগোচ্ছেন। যদি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নভেম্বরে খুলে তাহলে সংক্ষিপ্ত পাঠ্যসূচি অনুযায়ী মূল্যায়ন হবে। আর তাও সম্ভব না হলে বছরের শুরুতে যে আড়াই মাস ক্লাস হয়েছিল, তার ভিত্তিতে মূল্যায়ন করা হবে। দেশে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় পৌনে ৩ কোটি। ইতিমধ্যে এই বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থীর পড়াশোনার ওপর বড় ধরনের প্রভাব পড়েছে। সংকট প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যায় পর্যন্ত থাকলেও বেশি প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে। বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইনে ক্লাস হচ্ছে, যদিও উপস্থিতি সন্তোষজনক নয়। প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীরা একে তো ছোট, তার ওপর এই দুই স্তরে বাসায় থেকেও পড়াশোনা ঠিকমতো হচ্ছে না। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে বড় শহরে কিছুসংখ্যক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অনলাইন ক্লাস নিলেও সেগুলোর বেশির ভাগে পাঠদান এখন পর্যন্ত মানসম্মত হয়নি। কারণ, আগে থেকে প্রস্তুতি ছিল না। অনলাইনে পাঠদানে বৈষম্যও আছে। শহরের সচ্ছল পরিবারের শিক্ষার্থীরা এমনিতেই পড়াশোনায় এগিয়ে থাকে। করোনা পরিস্থিতিতে তারা ক্লাস ও পরীক্ষার সুযোগ পাচ্ছে অনলাইনে। শহর ও গ্রামের নিম্নবিত্ত পরিবারের শিক্ষার্থীরা সে সুযোগ পাচ্ছে না। সরকার গত ২৯ মার্চ থেকে মাধ্যমিকের এবং ৭ এপ্রিল থেকে প্রাথমিকের রেকর্ড করা ক্লাস সংসদ টেলিভিশনে প্রচার করছে। কিন্তু টেলিভিশনের ক্লাস খুব একটা কার্যকর মনে হচ্ছে না। জরিপ অনুযায়ী, পঞ্চম শ্রেণির ৫৬ শতাংশ শিক্ষার্থী টেলিভিশনের ক্লাসে অংশগ্রহণ করছে যাতে অনুপস্থিত প্রায় অর্ধেক। মাধ্যমিক স্তরের ক্লাসের চিত্রটিও কমবেশি একই। এ অবস্থায় ১২ আগস্ট থেকে বাংলাদেশ বেতারের মাধ্যমে প্রাথমিক স্তরের ক্লাস প্রচার শুরু হয়। আবার টেলিভিশন ও বেতারে ক্লাস এককেন্দ্রিক হওয়ায় এখানে শিশুরা আনন্দ পায় না। প্রশ্ন করারও সুযোগ নেই। এসবে ক্লাস হলেও মূল্যায়নের সুযোগ নেই। ফলে এটি ফলপ্রসূ হচ্ছে না। এটি শিক্ষার্থীদের জন্য ভয়াবহ ভবিষ্যতের চিহ্ন বহন করছে। বছর শেষে অটোপাস দিয়ে দিলে হয়ত শিক্ষাবর্ষ চালিয়ে নেয়া যাবে কিন্তু প্রায় সাড়ে তিন কোটি শিক্ষার্থী কিছুটা হলেও অদক্ষতা বা অপরিপক্কতায় ভুগবে। যা একটি জাতির মেরুদণ্ডের হাড় ভেঙে যাওয়ার সমান। বলা বাহুল্য, উদ্ভুত পরিস্থিতিতে করোনা ঝুঁকির চেয়ে পড়ুয়াদের "শিক্ষা ঝুঁকি" বেশি মারাত্মক আকার ধারন করেছে। এদিকে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকলেও শিল্প কলকারখানা, অফিস, ব্যাংক, বন্দর থেকে শুরু করে চায়ের টং পর্যন্ত দেদারসে চলছে সামাজিক মেলামেশা। সামান্য মাস্কটিও অনেকে পড়ছেন না। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীরও যেন এ ব্যাপারে তেমন কোন উদ্যোগ নিতে দেখা যাচ্ছে না। তাই সারাদেশ যখন উন্মুক্ত তখন মাসের পর মাস শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ না রেখে নিরাপদ দূরত্ব বজায় থাকে এমন পাঠদানের পন্থা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের খোঁজা এবং তা অচিরেই কার্যকর করা উচিত। প্রয়োজনে বেসরকারি সংগঠন বা ফাউন্ডেশনের সহায়তা/পরামর্শ নিয়ে সরকারকে দ্রুত কাজটি সম্পন্ন করতে হবে। আর এইরকম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধের মহড়া চলতে থাকলে আমরা ভবিষ্যতে করোনার চেয়ে গুরুতর সমস্যার মধ্যে পড়ব।
কোন মন্তব্য নেই